ঋণের দুষ্টচক্র ও অর্থনীতির কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ

 


বাংলাদেশের ঋণের বেড়ে ওঠা নিছক অর্থনৈতিক নয়—এটি গভীরভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরন ও শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে ঋণের বোঝা দ্রুত বেড়েছে। জেনারেল এরশাদের শাসনে ১৯৮২ সালের ৭.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ১৯৯০ সালে বেড়ে ১৪.৫ বিলিয়নে দাঁড়ায়। বর্তমান সরকারের সময়ে ২০০৯ সালের ২৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ২০২৪ সালে ১০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে—প্রায় ৩২২ শতাংশ বৃদ্ধি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ঋণনির্ভর পৃষ্ঠপোষকতা। এই দুষ্টচক্র না ভাঙলে দেশ ‘ঋণ নিয়ে ঋণ শোধ’-এর পথে চলতে থাকবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এমন এক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসেছে, যেখানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল রাজস্ব আহরণ, বাজেট বাস্তবায়নের ধীরগতি, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট বিরাজ করছে। আগামী বাজেটে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কৌশল জরুরি।

ঋণ পরিস্থিতি: একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামো

২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৭.৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ-রাজস্ব অনুপাত ২৭৬ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ-রপ্তানি অনুপাত ১৪৬.২ শতাংশ—উভয়ই ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায়। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট সরকারি ঋণ ১৮.৩২ লাখ কোটি টাকা, যেখানে গত ১৫ বছরে ঋণ বেড়েছে বছরে গড়ে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধই বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।

রাজস্ব আয় ও বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা

রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে রাজস্ব আয় বেড়েছে মাত্র ৪.৪ শতাংশ। বছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন ৫৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি, যা বাস্তবতাই অসম্ভব। একই সঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

ঋণনির্ভর ব্যয়: ফলহীন বিনিয়োগ

ঋণের টাকায় বাস্তবায়িত অনেক বড় প্রকল্প সময়মতো শেষ হয়নি বা প্রত্যাশিত আয় দেয়নি। ফলে সেসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে নতুন আয় বা ঋণের মাধ্যমে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও নির্বাচনে কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

সমাধানের দিকনির্দেশনা: পাঁচটি কৌশল

১. অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলের উদ্যোগ:
স্বৈরশাসনের সময়ে গৃহীত ঋণগুলো পর্যালোচনার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাধীন কমিশন গঠনের অনুরোধ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের সাদ্দাম আমলের ১২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণকে অবৈধ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছিল।

  1. ঋণ-বিনিয়োগ বিনিময় কৌশল:
    বৈদেশিক ঋণকে স্থানীয় বিনিয়োগে রূপান্তর করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জলবায়ু অভিযোজন খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

  2. ব্যয় অগ্রাধিকার ও দক্ষতা বৃদ্ধি:
    অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি কমিয়ে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে জীবনচক্রভিত্তিক কাঠামোয় এনে এবং ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা আনতে হবে।

  3. ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল:
    স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, সুদ হ্রাস ও ঋণের গঠনগত উন্নয়ন আনতে হবে। ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল (MTDS)’ বাস্তবায়ন করা দরকার।

  4. অভ্যন্তরীণ ঋণবাজার শক্তিশালীকরণ:
    ব্যক্তি খাতের ঋণপ্রবাহ যেন সংকুচিত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাজারকে গভীর ও কার্যকর করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশ এখনো ঋণ ফাঁদের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়নি, তবে ঝুঁকি প্রকট। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা স্বল্পমেয়াদি সংকট সামাল দিতে সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। কেবল ঋণ কমানো নয়, বরং রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিবর্তন, দায়বদ্ধতা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকেই যেতে হবে।


Post a Comment

0 Comments