২১ নভেম্বর ২০২৪, করাচি: পাকিস্তানের করাচিতে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশন অ্যান্ড সেমিনারে গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ডিফেন্স সলিউশনসের তৈরি শাহপার ড্রোন দেখতে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা।
৮ মে রাত আটটার কিছু পর ভারতের জম্মু শহরের আকাশে লাল আলোর শিখা ছুটে যেতে দেখা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুলি ছোড়ে। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, এগুলো পাকিস্তান থেকে আসা ড্রোন।
গত কয়েক দশকে নানা সংঘাতে ভারত-পাকিস্তান উভয়ই যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে। তবে চলতি মে মাসের চার দিনের সংঘর্ষে প্রথমবারের মতো দুই দেশই বড় আকারে ড্রোন ব্যবহারে মনোযোগ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর সংঘাত সাময়িকভাবে থামলেও দুই দেশের মধ্যে এখন ড্রোনকে কেন্দ্র করে এক নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে—এমনটাই উঠে এসেছে রয়টার্সের নেওয়া ১৫ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তা, বিশ্লেষক ও শিল্প–নির্বাহীর সাক্ষাৎকারে।
২০২৪ সালে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই প্রতিরক্ষা খাতে ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। পাকিস্তান তার উন্নতমানের যুদ্ধবিমানগুলো ঝুঁকিতে না ফেলে বেশি সংখ্যক ইউএভি সংগ্রহে মনোযোগী। অন্যদিকে ভারত আগামী ১২ থেকে ২৪ মাসে ইউএভি খাতে ৪৭ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে, যা পূর্ববর্তী ব্যয়ের তিনগুণ।
ভারতের ড্রোন ফেডারেশনের কর্মকর্তা স্মিত শাহ বলেন, “স্থানীয় ড্রোন শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসছে।” আরেক কর্মকর্তা জানান, সরকার এখন দ্রুত ড্রোন নির্মাতাদের ডেকে তাদের প্রযুক্তি যাচাই করছে।
ভারত সরকার সম্প্রতি জরুরি সামরিক কেনাকাটার জন্য ৪৬০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। এ তহবিলের একটি অংশ ড্রোন ও নজরদারি সরঞ্জামে ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভারতীয় কোম্পানি আইডিয়াফোর্জের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশাল সাক্সেনা জানান, সরকারের অগ্রাধিকার এখন ড্রোন প্রযুক্তিতে। সন্ত্রাসবিরোধী ও সামরিক উভয় ব্যবহারের উপযোগী ইউএভি উৎপাদনে তারা জোর দিচ্ছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই। দেশটির একটি সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ তুরস্কের বায়কার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ইহা-৩ ড্রোন দেশীয়ভাবে তৈরি করছে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পার্কে এসব ড্রোন মাত্র দুই থেকে তিন দিনেই সংযোজন সম্ভব হচ্ছে।
চলতি সংঘর্ষে পাকিস্তান ও ভারত উভয়ই ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করলেও ইসলামাবাদের চেয়ে ভারতের আধুনিক যুদ্ধবিমানের সংখ্যা বেশি। ভারতের কাছে ৩০টির বেশি রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের হাতে রয়েছে প্রায় ২০টি চীনা জে-১০ যুদ্ধবিমান।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রয়টার্সের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানালেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসলামাবাদ চীন ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ড্রোন খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে।
ড্রোন যুদ্ধের উত্তেজনাহীন চাপ
কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, “ভারত ও পাকিস্তান ড্রোন হামলাকে এমন এক মাধ্যম হিসেবে দেখছে, যার মাধ্যমে সামরিক চাপ সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু তা সরাসরি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায় না।”
তিনি আরও বলেন, “ড্রোনগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, ঝুঁকি কম এবং জনগণের মনোভাবকে প্রভাবিত করতেও উপযোগী। তবে এ ধরনের হামলা বিতর্কিত বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও রাখে।”
২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাল্টা জবাবে ৭ মে ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। ১১ মে পাকিস্তান একযোগে সীমান্তের বিভিন্ন অংশে ড্রোন পাঠিয়ে জবাব দেয়।
দুই পাকিস্তানি সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ তুর্কি ইহা-৩ ও সোনগার ড্রোনের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের তৈরি শাহপার-৩ ব্যবহার করেছে। ভারতীয় বাহিনী দাবি করে, তারা স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তানের পাঠানো বেশির ভাগ ড্রোন ধ্বংস করেছে, যদিও পাকিস্তান সে দাবি অস্বীকার করেছে।
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার অংশুমান নারাং বলেন, “আমাদের বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রগুলো ড্রোন প্রতিরোধের জন্য তৈরি ছিল না, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো প্রত্যাশার চেয়েও ভালো কাজ করেছে।”
ভারতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় এখন আত্মঘাতী ড্রোনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দেশটির একাধিক কর্মকর্তা ও ইউএভি নির্মাতারা জানিয়েছেন, তারা এমন ড্রোন তৈরি করছেন, যেগুলো দীর্ঘক্ষণ আকাশে থেকে লক্ষ্যবস্তু নির্ভুলভাবে আঘাত করতে পারে।
নতুন যুদ্ধের ধরন
ভারতীয় নির্মাতা নিউস্পেসের সামির জোশি বলেন, “এই আত্মঘাতী ড্রোনগুলো শত্রুপক্ষের আকাশসীমায় অনায়াসে ঢুকে পড়তে পারে, সহজে ধরা পড়ে না এবং লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।”
তিনি জানান, “যুদ্ধের ধরন এখন বদলে যাচ্ছে। কম খরচে, কম ঝুঁকিতে বেশি কার্যকরতা—এই লক্ষ্যেই ড্রোনের দিকে ঝুঁকছে দেশগুলো।”
ড্রোন প্রযুক্তিকে আরও শক্তিশালী করতে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইলেকট্রনিক যুদ্ধ উপযোগী ইউএভি তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “ড্রোন হয়তো ক্ষেপণাস্ত্র বা যুদ্ধবিমানের মতো ভয়াবহ নয়, কিন্তু এগুলো প্রতিপক্ষকে বার্তা দেওয়ার কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।”
0 Comments