জাতীয় নির্বাচনের অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের সঙ্কট

 


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে জটিলতা ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা অস্বীকার করা মানেই বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। দায়ভার ১৮ কোটি মানুষের নয়, কিন্তু তার ফল ভোগ করতে হবে তাদেরই।

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ৫ আগস্টে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটল, তা আশান্বিত হলেও তার পরবর্তী পরিস্থিতি হতাশাজনক—অপ্রত্যাশিত নয়।

বিপ্লবের চেতনায় একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক সমাজের যে আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল, তা কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামো বা রূপরেখায় রূপ নেয়নি। ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এখন অনেকের কাছেই অতীতের উপদেশের মতো মনে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল—দেশকে সহিংসতা, দুর্নীতি ও ফ্যাসিবাদী আমলের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের পথে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু সরকারের ভবিষ্যৎ গতিপথ ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়ার অভাব থেকেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জন্ম নিচ্ছে।

বিশেষ করে, বিএনপির ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের জুন ২০২৬ পর্যন্ত সময়ের কথা বলার মধ্যকার ব্যবধান এই টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটি কেবল সময়ের প্রশ্ন নয়, বরং আস্থার অভাব ও কার্যকর সংলাপের অভাব বড় কারণ।

রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহে জর্জরিত। এই সংকট তৈরি করেছে এক ধরনের ‘নৈরাজ্য’—যা বিপ্লবের ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণের সংযোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

এ অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দুটি:
১. ইউনূস সাহেব যদি সরে দাঁড়ান, তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন আদৌ সম্ভব হবে কি?
২. যদি জাতীয় স্বার্থ ও সংস্কারের রূপরেখা উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি নির্বাচন হয়, তবে কি বিপ্লবের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে?

এই দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি। পরাজিত ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী মাঠে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে এবং ৫ আগস্টের সহিংসতা ঠেকানোর মতো জনগণের ঐক্য এবার হয়তো দৃশ্যমান থাকবে না।

রাজনীতিতে চরমপন্থা বেছে নেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে বহুবার বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ব্যক্তিগত জেদের প্রাধান্য জাতীয় স্বার্থকে গৌণ করে তোলে। শেখ হাসিনার আমল তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিপ্লব-পরবর্তী আশাবাদ এখন ঝুঁকির মুখে। এই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনূসের আবেগে ভেসে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাঁর কাঁধে জাতীয় রূপান্তরের গুরুদায়িত্ব।

তাঁর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ যখন হয়েছে, ভুল বোঝাবুঝি কমেছে। তবে সব সময় তাঁর পক্ষে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব নয়, বরং কখনো কখনো তা রাজনৈতিকভাবে বেমানান। অনেক রাজনীতিক তাঁর সামনে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতেও সংকোচবোধ করেন।

এই কারণে একটি উচ্চপর্যায়ের ‘ট্রানজিশন টিম’ গঠনের প্রস্তাব যৌক্তিক—যা অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সার্বক্ষণিক সংলাপ নিশ্চিত করতে পারবে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আক্রমণাত্মক ভাষা, ‘হাসিনা-ধাঁচের’ প্রতিপক্ষকে হেয় করার সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের লাগামহীন বক্তব্যও পরিস্থিতি আরও জটিল করছে।

নতুন বাস্তবতা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে, যারা ‘জুলাই বিপ্লব’-এ জীবন বাজি রেখেছিল, তাদের কাছে পুরোনো ঘরানার বক্তৃতাবাজি ও দম্ভ এখন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।

তাদের আগ্রহ ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তব পরিকল্পনায়। তারা জানতে চায়—কোন দল কিভাবে দেশকে বদলাতে চায়, তাদের ভবিষ্যৎ কীভাবে গড়বে।

শান্তিপ্রিয় মানুষ একটি এমন ব্যবস্থা চায়, যেখানে তারা ভোট দিতে পারবে, কথা বলতে পারবে এবং ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাস ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

এই বাস্তবতায় অধ্যাপক ইউনূস যদি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আরও উন্মুক্ত হন, তাতে তাঁর মর্যাদা বাড়বে। অন্যদিকে বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক দলগুলো যদি সংলাপে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তাদেরই নেতৃত্ব ভবিষ্যতের পথে সম্মানজনক হবে।

গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়—মানে সংলাপ, অংশগ্রহণ এবং নৈতিক ভিত্তিতে ক্ষমতা অর্জন ও চর্চা। ইতিহাস বলে, একক সিদ্ধান্ত ও জেদের জায়গা থেকে নয়, বরং সম্মিলিত চেষ্টাতেই জাতীয় রূপান্তর সম্ভব।


Post a Comment

0 Comments