রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ঢাকায় সন্ত্রাসী তৎপরতায় নতুন মাত্রা

 


জুলাইয়ের গণ–আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানী ঢাকায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ ও এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।

তবে মিরপুর, পল্লবী ও কাফরুল এলাকায় পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভিন্ন। এসব এলাকায় অপরাধীদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা থাকায় সংঘাতের ঘটনা কম।

দুই দশক পর জামিনে মুক্তি পাওয়া মোহাম্মদপুরের আলোচিত সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে ‘পিচ্চি হেলাল’–এর নাম আসে আবার আলোচনায়। ২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে সংঘটিত জোড়া খুনের পেছনে ছিল সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধ। ঘটনায় হেলালের বিরুদ্ধে মামলা হয়, যার পর তিনি কিছুটা চাপে পড়েন।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হেলালের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যাপ্টেন ইমনের ঘনিষ্ঠ অনেক সহযোগী গ্রেপ্তার হন। ইমনের প্রভাব কমে গেলে হেলাল আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। এতে অভিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন ইমন। ঘটনার পর হেলালের ভাই মামলা করেন, ফলে দুই পক্ষের সংঘাত আরও প্রকট হয়।

বিদেশে বসেই নিয়ন্ত্রণ

মিরপুর, পল্লবী ও কাফরুল এলাকায় চার শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে অবস্থান করছেন বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাঁরা বিদেশ থেকে ফোনে নির্দেশনা দেন, আর বাস্তবায়ন করেন স্থানীয় ‘গ্যাং’ সদস্যরা। কোথাও কোথাও কিশোরদের ব্যবহার করেও অপরাধ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রাজধানীর অপরাধজগতে নেতৃত্ব বদল হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দমনে এখনই রাজনৈতিক সদিচ্ছা না দেখালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. নজরুল ইসলাম জানান, সন্দেহভাজন শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দেশে না থাকায় এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার না করায় তাঁদের চিহ্নিত করা কঠিন হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় যাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাঁদের ধরতে এলাকাভিত্তিক অভিযান চলছে।

গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ায় গ্রেপ্তার হন আলোচিত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাতিরঝিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও দুই সহযোগীকে।

মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগে অস্থিরতা

সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুর, বছিলা ও হাজারীবাগ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। খুন, চাঁদাবাজি, প্রকাশ্য অস্ত্র মহড়া—সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়।

গত দুই মাসে এ এলাকায় অন্তত ১৭টি বড় অপরাধের তথ্য পাওয়া গেছে। ১৫ মে রাতে এক বাসার সামনে পরিবারের ছয়জনকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় ‘পাটালি গ্রুপ’কে দায়ী করা হয়। পেছনে ছিল পিচ্চি হেলাল ও ক্যাপ্টেন ইমনের আধিপত্য লড়াই।

১৬ মে জিগাতলায় খুন হন সামিউর রহমান (আলভি)। জানা যায়, এ হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনুসারীরা। ইমন বর্তমানে থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন বলে জানায় পুলিশ, তবে তাঁর সহযোগীদের তৎপরতা এখনো চলছে।

ভয়ে মুখ বন্ধ সাধারণ মানুষ

রায়েরবাজারের এক দোকানদার বলেন, ‘তাঁরা চাঁদা চায়, কথা বললে মেরে ফেলে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।’

২৪ মার্চ এবং ২৮ এপ্রিল শের শাহ সুরি রোডে একই বাড়ির সামনে দুই দফায় গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটে। অধিকাংশ সময় এসব ঘটনার মূল হোতা হিসেবে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম উঠে আসে।

মিরপুরে অপরাধের পাঁচ নাম

মফিজুর রহমান মামুন, শাহাদাত ওরফে সাধু, মোক্তার হোসেন, কিলার আব্বাস ও কিলার ইব্রাহিম—এই পাঁচজনের নেতৃত্বে চলছে মিরপুরে অপরাধ কর্মকাণ্ড। জমি, ব্যবসা, ঝুট কাপড়, ঠিকাদারি—সবকিছুতেই এদের দখলদারিত্ব চলছে।

এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘থানায় গেলেও নিরাপত্তা পাওয়া যায় না। সন্ত্রাসীরা জানলে শেষ করে দেবে।’ তবে পুলিশ বলছে, অভিযুক্তদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এলাকায় নেই।

কারামুক্ত হয়ে বিদেশে পাড়ি

আব্বাস আলী, এক সময়কার ভয়ংকর নাম, জামিনে বের হয়ে এখন আর আগের মতো সক্রিয় নন। তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে জানায় স্থানীয় সূত্র।

দমন ছাড়া উপায় নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সন্ত্রাস দমন সম্ভব নয়। অনেকে পুলিশকে তথ্য দিলেও তা সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যায়। এ কারণে মানুষ চুপ থাকে।’


Post a Comment

0 Comments